শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৫১ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না।’ ‘আজ নগদ কাল বাকি।’ ‘নগদ বিক্রি পেটে ভাত, বাকি বিক্রি মাথায় হাত।’ এমন উক্তি শুধু আমি নই, মোটামুটি বানান করে বাংলা পড়তে জানেন এমন মানুষ পাড়া-মহল্লার দোকানে সেই ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসছেন। উক্তিগুলোর সরল অর্থ, বাকি বিক্রি নয়; বাকি বিক্রি ভালো নয়। যদিও দোকানিদের এমন ‘বাণী কৌশল’ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজে লাগে না। বাকি বেচাকেনায় দোকানি লজ্জা পেলেও অনেক ক্রেতাই বাকিতে পণ্য কিনতে লজ্জা পায় না। ক্ষেত্রবিশেষ অনেকে বাকিতে কেনাটাকে ক্রেডিট মনে করে।
এ কারণেই আজও পড়া-মহল্লার ছোট দোকান থেকে শুরু করে ব্যবসায়-বাণিজ্যে বাকির প্রচলন রয়েছে। যদিও বাকির আধিক্যে অনেকেই বলেন, বাকিতে কেনাবেচার নিয়ম এবং পরে বাকি টাকা পরিশোধ না করার রীতি শুধু বাংলাদেশেই আছে। এই কথার পক্ষে কোনো জোরালো যুক্তি আমার কাছে নেই। তবে বাকিতে পণ্য বিক্রি করে বহু দোকানি নিঃস্ব হয়েছেন এমন খবর বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হয়।
সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থিত হোটেলে অনেক শিক্ষার্থী বাকিতে খেয়ে টাকা না দেওয়ায় বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র হোটেল ব্যবসায়ী ভয়ানক বিপদে পড়েছেন। পুঁজি শেষ হয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এ জাতীয় সংবাদ জাতীয় গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচারও হয়েছে। বাকিতে কেনাকাটা বা খাওয়া নতুন কোনো প্রবণতা নয়। তবে বিষয়টি কেন কোনো কোনো দোকান মালিকের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে, এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও প্রশ্ন।
ধর্মীয়, সামাজিকতা ও মানবিকতা উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম মানুষের জীবন সহজ ও স্বাভাবিক করার জন্য বাকিতে লেনদেনের অনুমোদন দিয়েছে। জীবনে চলার পথে যেকোনো পদক্ষেপে একজন মানুষ যেমন ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়, তেমনি আকস্মিক সংকটের মুখে কিংবা অনন্যোপায় হয়ে বাকিতে কোনো কিছু কিনতেও পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে। বাকিতে বিক্রি তো একপ্রকার ঋণই। বিভিন্ন আয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় এভাবে আলোচিত হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! যখন তোমরা নির্দিষ্ট মেয়াদে বাকিতে লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রেখো।’ -সুরা আল বাকারা : ১৮২
বর্ণিত আয়াতে অবশ্য বাকিতে লেনদেনের জন্য একটি বিশেষ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের লেনদেন যেখানে হয়, সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সাধারণত কোনো ধরনের পূর্বপরিচিতি থাকে। সেই পরিচয়ের সূত্রেই একজন বিক্রেতা নগদ টাকা না পেয়েও ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দেয়। কথামতো মূল্য পরিশোধ করে দেওয়া তাই বিবেক ও মানবিকতার দাবি। কিন্তু মানবিকতার একটি দুর্বল দিক হলো কখনো ক্রেতা ভুলে যেতে পারে তার দেনার কথা, ভুলে যেতে পারে তার দেনার পরিমাণের কথা। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে তখন আগের ঘনিষ্ঠতা ও পরিচিতি তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। মানবিক এ দুর্বলতা থেকে রেহাই পেতে তাই শুরুতেই তা লিখে রাখার বিকল্প নেই। কোরআন মাজিদ আমাদের সেদিকেই পথনির্দেশ করছে।
বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে বর্তমান সময়ে আমরা দুই ধরনের প্রান্তিকতা দেখতে পাই। ১. আধুনিক অনেক শপিংমল, যেখানে নগদ লেনদেনের বাইরে ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো সুযোগ নেই। ২. বিলাসবহুল কিছু পণ্যের বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়, যেখানে নামে কিংবা বেনামে সুদের লেনদেন হচ্ছে। অথচ ইসলাম এ উভয় ধরনের প্রান্তিকতা থেকে সরে এসে আমাদের মধ্যমপন্থায় চলতে শেখায়।
বাকিতে কোনো কিছু কেনার প্রয়োজন হতে পারে যে কারও। প্রয়োজনগ্রস্ত সেসব ব্যক্তির জন্য সাময়িক বাকিতে কেনার সুযোগ রাখা যেমন মানবিকতার দাবি, তেমনি বাকিতে লেনদেনের চোরাই পথে এসে অভিশপ্ত সুদ যেন আমাদের ইমান-আমলকে ধ্বংস করে না দেয়, বাকি পরিশোধ না করে আজীবন দেনার দায়ে আটকে থাকার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়- সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা মুমিন হিসেবে অপরিহার্য কর্তব্য।
বাকিতে লেনদেন করলে ইসলামের শিক্ষা হলো, তা লিখে রাখা। এটা মোস্তাহাব। ব্যাপকভাবে না হলেও বড় বড় লেনদেনের ক্ষেত্রে লিখে রাখার প্রচলন আমাদের মধ্যে এখনো আছে। চুক্তিপত্র লিখে রাখা মূলত ক্রেতার দায়িত্ব। ক্রেতা যদি নিজে লিখতে না পারে, তাহলে সে অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেবে। চুক্তিপত্র যে লিখে দেবে তার জন্যও রয়েছে ইসলামের নির্দেশনা। সে যেন যথাযথভাবে লিখে দেয়, কারও পক্ষপাতিত্ব না করে এবং কেউ তাকে লিখে দেওয়ার কথা বললে সে যেন অস্বীকৃতি না জানায়।
বাকিতে লেনদেনের সময় ইসলামের আরেক শিক্ষা সাক্ষী রাখা। এটাও মোস্তাহাব। করতে পারলে ভালো। দুজন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ ও দুজন নারীকে সাক্ষী রাখা। পরবর্তী সময় যেন কোনো রকম ঝামেলায় জড়াতে না হয়, সে জন্য ইসলামের এ নির্দেশনা। বড় লেনদেনের ক্ষেত্রে সাক্ষী রাখার প্রচলন আমাদের সমাজেও রয়েছে। সাক্ষী রাখার নির্দেশনা তো ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য। আর যারা সাক্ষী, তাদের জন্য নির্দেশনা হলো, তাদের যখন সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হবে, তখন তারা যেন অস্বীকৃতি না জানায়। পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক সময় অনেক ন্যায্য অধিকারীও তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাই সাক্ষী হিসেবে যখন কাউকে ডাকা হয়, তখন সে যেন সাক্ষ্য দেয়।
পারস্পরিক ঝগড়া মিটিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এ এক সামাজিক পদক্ষেপ, সামাজিক সেবা। ব্যক্তিগত একটু কষ্ট সয়ে নিয়ে হলেও এ সেবা করা উচিত। কোরআন মাজিদের ভাষায়, ‘যে সাক্ষীদের তোমরা পছন্দ করো তাদের থেকে দুজন পুরুষকে সাক্ষী রেখো, যদি দুজন পুরুষ না হয় তাহলে এক পুরুষ ও দুই নারী…। আর সাক্ষীদের যখন ডাকা হয় তারা যেন অস্বীকৃতি না জানায়।’ -সুরা বাকারা : ১৮২
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com